Wednesday, 23 November 2016

কুরআন থেকে পাওয়া কিছু দাম্পত্য টিপসঃ


একটা সুন্দর সংসার এর জন্য স্বামী-স্ত্রীর কি  করা উচিত, কি না করা উচিত এগুলো নিয়ে আমরা তো কত লেখাই পড়ি, কত মানুষের কত উপদেশই শুনিতার কতটা সত্য কতটা মিথ্যা কে জানে? কিন্তু, একটি সুখী বিবাহিত জীবন পাওয়ার জন্য কি করতে হবেসেই শর্তগুলি যদি সরাসরি আল্লাহর তরফ থেকে আসলে তাহলে কেমন নয়? যিনি স্রষ্টা তার চাইতে বেশী কে জানবে তার সৃষ্টি সম্পর্কে? ভেবে দেখুন, যেখানে মহান আল্লাহ্আমাদের সরাসরি বলে দিচ্ছেনএই যে মানুষ! শোনো! তুমি যদি সুখী সংসার চাও তোমাকে এই এই কাজগুলো করতে হবেতাহলে আমাদের কি আর অন্য কোনো দিকে তাকানো ঠিক হবে?


একটা আনন্দময় সংসারের জন্য স্বামী/স্ত্রীর পারষ্পরিক করণীয় কি হবেএই লেখায় তা আমরা কুরআন মাজিদের সূরা নিসা ৩৪ নং আয়াতের প্রথম অংশের আলোকে আলোচনা করব। আল্লাহ্এই আয়াতে প্রথমে ছেলেদের কি করণীয় তা বলেছেন, এরপর মেয়েদের কি করণীয় তা নিয়ে বলেছেন। আমি আয়াতটির বাংলা অনুবাদে ইচ্ছে করে গুরুত্বপূর্ন শব্দগুলোকে আরবীতে রাখব। তারপর সেই আরবী শব্দগুলোর অর্থ ধরে ধরে স্বামী/স্ত্রীর পারষ্পরিক করণীয় কাজগুলির তালিকা বের করব। আসুন তাহলে শুরু করা যাক


মহান আল্লাহ্বলেন:

ছেলেরা মেয়েদের ব্যাপারেক্বাওয়ামহবে; কারণ, আল্লাহ্তাদের কাউকে কারো উপর সুবিধা দিয়েছেন, এবং কারণ তারা তাদের সম্পদ থেকে ব্যয় করবে
কাজেই, “সালিহামেয়েরা হবেকানিতাহাফিযা” – হেফাযত করবে যা দেখা যায় না এবং যা আল্লাহ্তাদেরকে হেফাযত করতে বলেছেন।    

আয়াতাংশটা যে জটিল সন্দেহ নেই। লক্ষ্য করলে দেখবেন, এখানে আসলে দুইটা বাক্য আছে (উল্লেখ্য, বাক্য আর আয়াত এক জিনিস নয়। অনেক বাক্য মিলে এক আয়াত হতে পারে, আবার একাধিক আয়াত মিলেও একটা বাক্য হতে পারে) প্রথম বাক্যে আল্লাহ্ছেলেদের করণীয়গুলি নিয়ে বলেছেন, আর দ্বিতীয় বাক্যে বলেছেন মেয়েদের করণীয়গুলি নিয়ে
ছেলেদের করণীয় কাজগুলি দিয়ে শুরু করা যাক

ছেলেদের করণীয়:

ছেলেদের করণীয় বুঝতে হলে আমাদেরকেকাওয়ামশব্দের অর্থ বুঝতে হবে। আরবী ভাষায় একটা ক্রিয়া (verb) কে বুঝা যায় তার বিপরীত ক্রিয়ার সাথে তুলনা করে। কাওয়াম বা উঠে দাঁড়ানো হলো বসে থাকার উল্টো। কাওয়াম বুঝায় সক্রিয়তা, যা নিষ্ক্রিয়তার উল্টো

ছেলেদের করণীয় : সম্পর্কের সকল ক্ষেত্রে উদ্যোগী (active) হবে

আল্লাহ যখন বলছে ছেলেদেরকাওয়ামহতে হবে, তখন তিনি বলছেন সম্পর্ক রক্ষায় ছেলেদের এক্টিভ হতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে, শুরু করতে হবে। একটা ছেলে যখন তার স্ত্রীকে দেখবে সে রান্নাঘরের কাজ নিয়ে, বাচ্চা নিয়ে পেরেশান হয়ে যাচ্ছেতখন নিজের উদ্যোগে এগিয়ে যেয়ে সাহায্য করতে হবে। ছুটিতে কোথায় বেড়াতে যেতে মন চায়সেটা ছেলেকেই আগে জিজ্ঞেস করতে হবে। বিবাহ বার্ষিকীতে স্ত্রী কি করছে তার জন্য অপেক্ষা না করে নিজেকেই আগে শুভেচ্ছা জানাতে হবে
ভুল বুঝা-বুঝি, ঝগড়া হলে ছেলের যতই ইচ্ছে করুক ম্যান-কেইভ (পুরুষ-গুহা) যেয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে, যতই মনে আসুক ভুল করেছে ওকে ক্ষমা চাইতে হবে’, নিজের মনের এই সব ইচ্ছাকে জলাঞ্জলী দিয়ে উদ্যোগী হতে হবে, ঝগড়াঝাটির জন্য অনুতপ্ত হতে হবে, এগিয়ে যেয়ে ক্ষমা চাইতে হবে, মন থেকে ক্ষমা করে দিতে হবে মেয়েরা সৃষ্টিগতভাবে লাজুক প্রকৃতির, তাই এমনকি অন্তরঙ্গ হওয়ার ক্ষেত্রেও ছেলেকেই উদ্যোগ নিতে হবে

ছেলেদের করণীয় : সম্পর্ক নবায়নে ক্রমাগত চেষ্টা চালাবে/ Showing continuous commitment

কাওয়াম শব্দের আরেক অর্থ হলোকোন কিছু দৃঢ়ভাবে ধরে রাখা, কিছুতেই ছেড়ে না দেয়া। আরবি ভাষার একটা বৈশিষ্ট্য হলো কোন শব্দের মধ্যে যদি কোন অক্ষর পরপর দুইবার আসে তাহলে তা পুনরাবৃত্তি আধিক্য বুঝায়। যেহেতু কাওয়াম শব্দের মাঝখানেওয়াওঅক্ষরটি দুইবার আছে, তাই এখানে কাওয়াম শব্দের মাধ্যমে বলা হচ্ছেছেলেদের বার বার চিন্তা করে দেখতে হবে, প্ল্যান করতে হবে, কি করলে আমাদের সম্পর্কটা দিনে দিনে আরো চুম্বকীয় হবে
আরে তো আমারই, কি আর আমাকে ছেড়ে যাবে’ – এই জাতীয় চিন্তা বাদ দিতে হবে। কাজের মধ্যে থাকুন, অফিসে থাকুন আর যেখানেই থাকুন, ফোন করে খবর নিতে হবে। শত ব্যস্ততার ভিড়েও প্রায়োরিটি দিয়ে স্ত্রীর জন্য সময় বের করতে হবে। স্ত্রী সুন্দর করে সাজলে তার প্রশংসা করতে হবে। কারণ ছাড়াই মাঝে মধ্যে স্ত্রীকে স্পর্শ করতে হবে, জড়িয়ে ধরতে হবে। আয়েশা রা. এর হাদিস থেকে আমরা জানি রাসূলুল্লাহ সা. বাসা থেকে বের হওয়ার সময় প্রায়ই তাঁকে চুমু দিয়ে বের হতেন

ছেলেদের করণীয় : ছেলেরা মেয়েদের শারিরীক মানসিকভাবে প্রতিরক্ষা (to protect her) করবে

কাওয়াম শব্দের তৃতীয় অর্থ হলো – physically কোন কিছুর সাথে থাকা তাকে protect করা। অর্থাৎ, আল্লাহ্বলছেন ছেলেরা মেয়েদের কাছাকাছি থেকে তাদের নিরাপত্তা দিবে, কখনো একাকিত্ব বোধ করতে দিবে না। এই প্রোটেকশন কিন্তু শুধু শারীরীক নয়, মানসিকও। মেয়েরা ছেলেদের চাইতে বেশি আবেগপ্রবণ হওয়ায় লোকে কি বললো তা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করে, কেউ বাজেভাবে কথা বললে অনেক বেশি ভেঙ্গে পড়ে। কোনো মেয়ে যখন তার মানসিক অশান্তি নিয়ে কথা বলবেএকজন ছেলে সেটাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে না, কটাক্ষ করবে না, উপদেশ না দিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুধু শুনবে। ছেলেরা মেয়েদের প্রোটেকশন দিবেশারীরিকভাবে এবং মানসিকভাবে

ছেলেদের করণীয় : ছেলেরা মেয়েদের প্রয়োজন (to fulfill her needs) পূরণ করবে

কাওয়াম শব্দের চতুর্থ অর্থ হলোযত্ন নেয়া, পরিচর্যা করা, Take-care করা, চাহিদা পূরণ করা। মহান আল্লাহর একটা নাম হলোআল-কাইয়ূম যা একই শব্দমূলকা-মাথেকে এসেছে। কাইয়ূম শব্দের অর্থ হলোযে শুধু সৃষ্টি করেই ছেড়ে দেয়নি, সবসময় তার যত্ন নিচ্ছে, দেখ-ভাল করছে। আল্লাহ এই আয়াতে কাওয়াম শব্দের মাধ্যমে আমাদের বলছেনছেলেরা মেয়েদের যত্ন নিবে, দেখ-ভাল করবে, তাদের কি প্রয়োজন তা জিজ্ঞেস করবে, জানতে চাইবে

ছেলেদের করণীয় : ছেলেরা মেয়েদের সাথে ন্যায্য (fair) আচরণ করবে

কাওয়াম শব্দের পঞ্চম অর্থ হলো–  কাউকে বা কোন কিছুকে তার ন্যায্য পাওনা দেয়া। আমরা প্রায়ই শুনে থাকি– ‘আল্লাহ্নামাজ কায়েম করতে বলেছেন।আমরা কিন্তু বলি না আল্লাহ্নামাজ পড়তে বলেছেন। কারণকায়েমশব্দটা আরো উঁচু স্তরের শব্দযার অর্থ যতটুকু মর্যাদা গুরুত্বের সাথে নামাজ পড়া দরকার ঠিক সেভাবে নামাজ পড়া। অন্যভাবে বলতে গেলেআমাদের উপর নামাজের যে দাবি তা ন্যায্যভাবে আদায় করা
একইভাবেমেয়েদের ব্যাপারে ছেলেদের খুব সতর্কতার সাথে তার ন্যায্য অধিকার দিতে হবে। আল্লাহ একজন ছেলেকে তার পরিবারের মেয়েদের উপর জিম্মাদার করে পাঠিয়েছেন। তাই একজন ছেলে নিজেকে সবসময় জিজ্ঞেস করবেআমি কি ওর সাথে ন্যায্য আচরণ করছি? আমার শক্তি বেশি, গলার জোর বেশি, মনের দৃঢ়তা বেশিএগুলো ব্যবহার করে আমি ওর উপর কোন জুলুম করছি না তো?
রাসূলুল্লাহ সা. বলেনতোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো সেই ব্যক্তি যে তার স্ত্রীর/পরিবারের প্রতি শ্রেষ্ঠ (মুসলিম)  

ছেলেদের করণীয় : ছেলেরা মেয়েদের খরচ চালাবে

ছেলেরা মেয়েদের ব্যাপারেক্বাওয়ামহবে; কারণ, আল্লাহ্তাদের কাউকে কারো উপর সুবিধা দিয়েছেন কারণ তারা তাদের সম্পদ থেকে ব্যয় করবে।সূরা নিসা :৩৪ আয়াতাংশ
নারীর জন্য খরচ করার ব্যাপারে কিপ্টেমি করা যাবে না। ইসলামে এমনকি ডিভোর্স দেয়ার সময়েও গিফট দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কাজেই, স্ত্রী থাকাকালীন সময় যে গিফট দিতে হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনকেউ তার পরিবারের জন্য যা ব্যয় করে তা সাদাকাহ বলে গণ্য হয়
উপরের কথাগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারছি আল্লাহ ছেলেদেরকে মেয়েদের ব্যাপারে অনেক দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। আর লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলোআল্লাহ কিন্তু বলেননিস্বামীরা স্ত্রীর ব্যাপারে কাওয়াম হবে’, বরং বলেছেনছেলেরা মেয়েদের ব্যাপারে কাওয়াম হবে।অর্থাৎ, একজন ছেলেকে শুধু তার স্ত্রীর সাথেই নয়, শরীয়ত তাকে যে সব নারীদের দায়িত্ব দিয়েছে তাদের সবার সাথেই তাকে কাওয়াম হতে হবে। একজন ছেলেকে তার মা, বোন, মেয়ে, খালা, ফুপুসহ সবার ব্যাপারে কাওয়াম হতে হবে। তাদের সবার সাথে সম্পর্ক রক্ষায় উদ্যোগী হতে হবে, যোগাযোগ রাখতে হবে, মানসিক-শারিরীক প্রতিরক্ষা দিতে হবে, কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করতে হবে, তাদের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে
দায়িত্বের এই লিস্ট পাওয়ার পর কোন ছেলে চার বিয়ে করা তো দূরে থাক, প্রথম বিয়ে করার আগেই একশবার চিন্তা করবেওরে বাবা! এত দায়িত্ব আমি পালন করতে পারবো তো? কেন যে পুরুষ হয়ে জন্মেছিলাম!
অধৈর্য হবেন না। এবার আসতে যাচ্ছে মেয়েদের দায়িত্বের তালিকা

মেয়েদের করণীয়:

সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতে ছেলেদের করণীয় কাজগুলি বর্ণনা করার পর আল্লাহ্মেয়েদের সম্পর্কে বলছেন
কাজেই, ‘সালিহামেয়েরা হবেকানিতাহাফিযা’– হেফাযত করবে যা দেখা যায় না এবং যা আল্লাহ্তাদের হেফাযত করতে বলেছেন।     
আল্লাহ বাক্যটি শুরু করলেনফাবাকাজেই/সুতরাংদিয়ে। অর্থাৎ, আল্লাহ্বললেন যেহেতু ছেলেদের অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে, মেয়েদেরও স্বাভাবিকভাবেই তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে
এরপর লক্ষ্য করুন বাক্যটির ব্যতক্রমী গঠন। আল্লাহ কিন্তু বলেননি– ‘মেয়েরা হবে সালিহা, কানিতা, হাফিযাবরং তিনি বলেছেন– ‘সালিহা মেয়েরা হবে কানিতা হাফিযা– ’ তার মানে আল্লাহ্বলছেন না যে সব মেয়েরা কানিতা, হাফিযা হতে পারবে। বরং, মেয়েদের প্রবণতা হলো কানিতা হাফিযা না হওয়া। শুধু সেই সব মেয়েই এই গুণ অর্জন করতে পারবে যারা সালিহা। অর্থাৎ, অন্য সব গুণ অর্জনের পূর্বশর্ত হলোসালিহাহওয়া। আসুন তাহলেসালিহাশব্দের অর্থ সম্পর্কে জানা যাক
সালিহাএসেছেসালাহাথেকে যার অর্থ একটি অর্থ হলোভালো কোন কিছু নষ্ট বা খারাপ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে সেটাকে ঠিক করে ফেলাকে আরবিতে বলেসালাহা স্কলাররা বলেন, এখানে আল্লাহ্মেয়েদের ব্যাপারেসালাহাশব্দটি ব্যবহার করেছেন কারণ মেয়েদের মধ্যে আল্লাহ এমন বিশ্লেষণী ক্ষমতা দিয়েছেন যে তারা চাইলে যে কোনো কিছুরই খুঁত ধরতে পারে। একজন মেয়ের স্বামী যতই তার সাথে ভালো করুক না কেন, সে চাইলেই তার দোষ ধরতে পারবেএই গুণ তার আছে। কিন্তু, আল্লাহ্সবচেয়ে প্রথমে এই কাজটিই করতে নিষেধ করছেন

মেয়েদের করণীয় : স্বামীর দোষ উপেক্ষা করবে

আল্লাহ্বলছেন একজন স্ত্রীর সবচাইতে বড় গুণ হলো স্বামীর দোষ এড়িয়ে যাওয়া, দেখেও না দেখার ভান করা, ভুলে যাওয়া। প্রত্যক্ষ্য বা পরোক্ষভাবে তার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ না করা।  রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন–  কেউ যদি তার স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে কোনও দোষ  দেখে বিরক্ত বোধ করে, তখন সে তার এমন গুণের কথা স্মরণ করুক যার জন্য সে তাকে ভালবাসে
মনোবিজ্ঞানীরা বলেনকোন মেয়ে যখন তার স্বামীর দোষ ধরে তখন স্বামীটি এটাকে তার Manliness আঘাত বলে মনে করে। ফলে, আরো বেশি চটে উঠে। স্বামীর  কোন দোষ চোখে পড়লে যথাসম্ভব চেষ্টা করুন তা না দেখার ভান করতে, আর একদমই সহ্য না করতে পারলে তাকে কটাক্ষ না করে বুঝিয়ে বলুন, অনুরোধ করুন

মেয়েদের করণীয় : সবকিছু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করবে

মানুষের দোষ উপেক্ষা করা সহজ না, খুব কঠিন একটা কাজ, আর স্বামীর সন্তুষ্টির জন্য করা তো আরো কঠিন। আর তাই মহান আল্লাহ মনে করিয়ে দিলেননা, না। তুমি দোষ উপেক্ষা করে ভালো আচরণ করবে, কারণ তুমিকানিতাকানিতাশব্দের অর্থ হচ্ছেযে খুশী মনে নিজের ইচ্ছার পরিবর্তে অন্যের ইচ্ছাকে মেনে দেয় কিন্তু, ‘কুনুতশব্দটি ইসলামে ব্যবহৃত হয় নিজের ইচ্ছার উপর আল্লাহর ইচ্ছাকে মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে। অর্থাৎএখানে আল্লাহ্বলছেনমেয়েরা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে স্বামীর সাথে ভালো আচরণ করবে, তার কথা শুনবে। স্বামীর সাথে একটা মেয়ের সম্পর্ক কতটা ভালো না মন্দতা দেখে বুঝা যায় আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক কতটা ভালো না মন্দ। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনআমি যদি তোমাদের আল্লাহ্ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করার হুকুম দিতাম তাহলে স্ত্রীদেরকে হুকুম করতাম স্বামীকে সিজদা করার জন্য (ইবনে মাজাহ) 

মেয়েদের করণীয় : স্বামীর অবর্তমানে তার দোষের কথা বলবে না

এরপর আল্লাহ্মেয়েদের বলেছেন, ‘হাফিযাবা প্রতিনিয়ত রক্ষা করতেআল্লাহ্তাদের রক্ষা করতে বলেছেনযা দেখা যায় না এর প্রথম অর্থ হলোস্বামীর অবর্তমানে মেয়েরা তার সম্মান রক্ষা করবে, তার দোষের কথা মানুষকে বলবে না, তার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করবে না। স্বামী-স্ত্রী হচ্ছে একে অপরের অংশ। একজন স্বামী/স্ত্রী যখন নিজের তার সঙ্গীর অবর্তমানে দোষের কথা বলে, তখন সে তার নিজের একটা অংশেরই অপমান করে

মেয়েদের করণীয় :  বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না

হাফিযাহওয়ার দ্বিতীর অর্থ হলো–  স্বামী যখন তাদের দেখছে না তখনও মেয়েরা তার বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না। অন্য পুরুষেরা হয়তো মেয়েটার সাথে বেশি বেশি কথা বলতে চাইবে, কাছে আসতে চাইবে, চান্স নিতে চাইবে। কিন্তু, মেয়েরা স্বামীর অবর্তমানে এমন কিছু করবে না, যা তার স্বামী সামনে থাকলে সে করতো না। স্বামী যেখানে যেতে নিষেধ করবে সেখানে যাবে না, যার সাথে কথা বলতে নিষেধ করতে তার সাথে কথা বলবে না, যে কাপড় পড়তে মানা করেছে তার পড়বে না।হাফিযহচ্ছে আল্লাহর একটি নাম। এর থেকেই বুঝা যায় মেয়েদের প্রতি অর্পিত এই দায়িত্ব কতটা পবিত্র

মেয়েদের করণীয় : স্বামীর আকাঙ্ক্ষা পূরণে নিজেকে প্রস্তুত (beautify herself) করবে

হাফিযাহওয়ার তৃতীয় অর্থ হলো মেয়েরা তার স্বামীর আকাংক্ষাকে রক্ষা (to protect his desire) করবে। স্ত্রীর অবর্তমানে স্বামী কোথায় যাচ্ছে সে কিন্তু জানে না। স্ত্রীর দায়িত্ব হলযাদের সে দেখতে পাচ্ছে না তাদের থেকেও স্বামীকে রক্ষা করা।  রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনশয়তান পরনারীকে ছেলেদের চোখে সুন্দর করে দেখায়। কাজেই, একজন মেয়ের দায়িত্ব হলো তার স্বামী যাতে শয়তানের সাথে লড়াইয়ে বিজয়ী হয় তাতে সাহায্য করা। স্বামী যখনই তার স্ত্রীর সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইবেঅনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্ত্রী তাকে না করবে না, কারণ এতে একজন স্বামী খুব কষ্ট পায়, তার মন ভেঙ্গে যায়। আর এই সুযোগে শয়তান এসে মনের মধ্যে ফিস ফিস করতে থাকেআমি বলেছিলাম না সে তোমাকে ভালবাসে না!
মনোবিজ্ঞানীরা বলেনছেলেরা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ বোধ করে চোখের দেখায় [] স্বামী ঘরের ফেরার আগে মাত্র মিনিট ব্যয় করেই কিন্তু একটা মেয়ে নিজেকে সুন্দর করে প্রস্তুত করতে পারে। মেয়েদের সহজাত প্রবণতা হলোস্বামী ছাড়া পৃথিবীর সবার জন্য সে সাজবে। অথচ, একটা মেয়েকে সুন্দর দেখার সবচেয়ে বেশি অধিকার হলো তার স্বামীর। এখানে বলা হচ্ছে না যে সব মেয়েদের সুপারমডেল হয়ে যেতে হবে। স্বামীরা জানে সংসারের দায়িত্ব পালন করতে একটা মেয়েকে কতটা পরিশ্রম করতে হয়। এখানে খুব সাধারণ সাজগোজের কথা বলা হচ্ছে যা /১০ মিনিটেই করা যায়
সাহাবাদের স্ত্রীরা স্বামীর ঘরের ফেরার সংবাদ পেলে নিজেকে সুন্দর করে প্রস্তুত করে রাখতেন। স্বামীর সামনে নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করাও একটা ইবাদত। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রাসূলুল্লাহ সা. এমনকি মদীনায় দূত পর্যন্ত পাঠাতেনঅনেক সময় নির্দেশ দিতেন যাতে স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের স্বাগত জানানোর জন্য সেজেগুজে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে। এতে সবচেয়ে বেশি লাভ কার? সবচেয়ে বেশি লাভ মেয়েদেরই। কারণ, যখন স্বামী বুঝতে পারবে তার স্ত্রী তাকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছে, তখন সে তার প্রতি আরো বেশি ভালাবাসা আকর্ষণ বোধ করবে। আর যখন স্বামী দেখবে স্ত্রী তার জন্য নিজেকে সুন্দর করে রাখে নাসেই স্ত্রী ক্রমেই তার স্বামীর ভালোবাসা হারাবে

শেষ কথা:

স্কলাররা [.] বলেনদুইটি মাত্র হাদিস আছেযার একটা স্বামীর জন্য আর আরেকটা স্ত্রীর জন্যএই একটা করে হাদিস যদি একজন স্বামী স্ত্রী মনে রেখে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারে তাহলে সেটাই তাদের সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য যথেষ্ট হবে
পুরুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাদিসটি হচ্ছে:
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন– ‘মেয়েদের সাথে কোমল আচরণ করো, কারণ তাদের বাঁকা পাঁজর থেকে তৈরি করা হয়েছে। আর সবচেয়ে বাঁকা হচ্ছে পাঁজরের উপরের অংশ। যদি তুমি একে সোজা করতে চাও এটা ভেঙ্গে যাবে, আর যদি ছেড়ে দাও তো বাঁকাই থেকে যাবে। কাজেই, মেয়েদের সাথে নমনীয় আচরণ করো’ [বুখারী মুসলিম, আবু হুরাইরা(রা) হতে বর্ণিত]
হাদিসটির ব্যাখায় স্কলাররা বলেন
) পাঁজর যেমন হৃদপিণ্ডকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে, একজন ভালো স্ত্রীও তার স্বামীকে বাইরের কলুষতা থেকে রক্ষা করে
) একজন স্বামীর দৃষ্টিতে অনেক সময় তার স্ত্রীকে গোঁয়ার হৃদয়হীনা বলে মনে হতে পারে। স্ত্রীর আচরণ ভুল মনে হলে স্বামী তার সাথে চীৎকার চেঁচামেচি করবে না, জোর করে নিজের মত চাপিয়ে দিবে না। বরং, কোমল আচরণের মাধ্যমে, শান্ত ভাষায় তাকে বুঝাতে চেষ্টা করবে
) স্ত্রীর সাথে জোরজবরদস্তির ফল কখনোই ভালো হবে না। বেশি জোড়াজুড়ি করলে সম্পর্কটি ভেঙ্গে পর্যন্ত যেতে পারে
) স্ত্রীর সাথে ঝগড়া-ঝাঁটি হয়ে গেলে তাকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য সময় দিতে হবে। ঠিক যেমনিভাঙ্গা হাড় জোড়া লাগার জন্য সময়ের প্রয়োজন হয়, মেয়েরা মন ভাঙলেও তা সারতে সময় লাগে। সুতরাং, একজন স্বামীকে তার স্ত্রীর দোষগুলি উপেক্ষা করে, গুণের কথা মনে রেখে, ধৈর্য ধরে, ভালো ব্যবহার করে যেতে হবে। আর, মহান আল্লাহ্ কাছে সুন্দর সম্পর্কের জন্য দু করতে হবে 
আর স্কলারদের মতে মেয়েদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাদিসটি হচ্ছে
রাসূলুল্লাহ   বলেন– ‘আমি যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সিজদা করার অনুমতি দিতাম, আমি স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সিজদা করার জন্য।’ 
(ইবনে মাযাহ, আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আউফা থেকে বর্ণিত)
এই হাদিসের ব্যাখায় স্কলাররা বলেনএকজন স্ত্রী তার স্বামীকে ভালবাসবে, সম্মান করবে তার মতামত অনুসারে কাজ করবে (হারাম কাজ ছাড়া) এবং তার সামনে নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করবে। তবে, স্বামীকে সম্মান করার অর্থ এই নয় যে স্বামী অন্যায়-অত্যাচার করলেও তাকে মুখ বুঁজে মেনে নিতে হবে। সম্মান করার অর্থ এটাও নয় যে স্ত্রী স্বামীর সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করতে পারবে না। বরং, স্ত্রী স্বামীর সাথে ভিন্নমত পোষন করতে পারবে, পরামর্শ দিবে, প্রয়োজনে যুক্তি সহকারে নিজের মতকে তুলে ধরবেকিন্তু এই সবই সে করবে সম্মানের সাথে, কটাক্ষের ছলে নয়। রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে তাঁর স্ত্রীরা অনেক সময় ভিন্নমত পোষণ করেছেন, হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় স্ত্রীর পরামর্শেই রাসূলুল্লাহ সা. সর্বপ্রথম তাঁর মাথার চুল চেঁছে ফেলেছিলেন
এখানে উল্লেখ্য, যদি এমন হয়একজন মেয়ের স্বামী তাকে কিছু করতে বলে, আর মেয়েটির পিতা-মাতা ভাই-বোন তাকে অন্য কোন কিছু করতে বলেএক্ষেত্রেও মেয়েটিকে তার স্বামীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হবে [] বিষয়ে পাশ্চাত্যের বহু রিলেশনশিপ এক্সপার্টও এখন বলেন– ‘দ্য হ্যাপিয়েস্ট ওয়াইফ ইজ দা সারেন্ডারড ওয়াইফ’ ( বিষয়ে লরা ডয়েল এর বেস্ট-সেলিং বইদা সারেন্ডারড ওয়াইফ” [] পড়ে দেখতে পারেন)
কোনো কিছুই এমনি এমনি হয় না যে কোনো কিছু পাওয়ার জন্যই চেষ্টা করতে হয়। একটা সুন্দর সুখী সংসার গড়ার জন্যও চেষ্টা করতে হয়। একটি সুন্দর-সুখী পরিবার গড়ার জন্য স্বামী স্ত্রী দুইজনকেই চেষ্টা করতে হবে। এর মধ্যে ভুল হবে, মান-অভিমান হবে, কিন্তু সেটাকে ধরে রাখলে চলবে না। একে অপরের ভুলকে উপেক্ষা করে সুন্দর সংসারের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে
[এই লেখাটি স্বামী-স্ত্রীর পারষ্পরিক দায়িত্বের কোন  পরিপূর্ণ/কম্প্রিহেনসিভ লিষ্ট নয়। ছেলে-মেয়ের সুন্দর, ভালাবাসাময়, শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য যে প্র্যাক্টিকাল স্টেপগুলো নিতে হবে শুধু সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই লেখায়। এগুলোর বাইরেও স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের প্রতি অনেক ধর্মীয় দায়িত্ব (যেমনপরষ্পরকে ইসলাম পালন করতে সাহায্য করা, উৎসাহ দেয়া, ইসলাম শিক্ষা করা ইত্যাদি) আছে।]

রেফারেন্স:

  1. Responsibilities of husband and wife (Khutbah) – Nouman Ali Khan
  2. Like a Garment – Yasir Qadhi
  3. Making marriage work (Khutbah) – Yasir Qadhi
  4. Marriage without criticism – SheKnows blog
  5. Hadith on prostrating husband https://islamqa.info/en/43123
  6. Sex and the power of the visual – PragerU
  7. The surrendered wife – Laura Doyle
*
কুরআন গবেষক স্কলার উস্তাদ নুমান আলি খানের “Responsibilities of Husbands & Responsibilities of Wives” খুতবাটি অনুসরণ করে লিখেছেন আদনান ফয়সাল  কিছু ব্যাখা নেয়া হয়েছে শেইখ ইয়াসির কাযীর “Like a Garment” লেকচার সিরিজ থেকে

No comments:

Post a Comment