ভূমিকা
মহান রাব্বুল আলামীন এই সুন্দর পৃথিবী
সৃষ্টি করে তাকে সুশোভিত করেছেন, সৃষ্টি করেছেন অরণ্য, গাছপালা-তরুলতা,
সাগর-নদী, আকাশ-বাতাস, চন্দ্র-সূর্য ও বিভিন্ন প্রকার প্রাণীকূল। আর এই
সৃষ্ট জগতে মানুষকে পাঠিয়েছেন আশরাফুল মাখলুকাত রূপে। স্রষ্টার এই সুন্দর
সৃষ্টি পরিচালিত হচ্ছে সুশৃঙ্খল নিয়ম-নীতি মেনেই। মানুষ তার পরম সত্তাকে
জানার জন্য সর্বদাই আকুল। এ দুর্নিবার জানার আগ্রহ মানুষকে এক নৈর্ব্যক্তিক
প্রষ্টার ধারনায় পৌঁছে দেয়। এ নৈর্ব্যক্তিক মহা সত্তা বা স্রষ্টা
নৈর্ব্যক্তিক থেকে মানুষের হৃদয়ের আবেদন পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছ। তাই মানুষ
যুগ যুগ ধরে নিজের অন্তরে সেই পরম সত্তাকে খুজে বের করে তার সাথে আত্মীক
সম্পর্ক গড়তে চেয়েছে। আর এ সত্তাকে জানতে ও চিনতে হলে তাকে অবশ্যই একজন
পবিত্র আত্মার মানুষ হতে হবে। আর পবিত্র আত্মার অধিকারী হতে হলে তাকে
অবশ্যই আদর্শিক ও চারিত্রিক গুণে গুণান্বিত হওয়া আবশ্যক। একজন মু’মিনকে
দেখে অপর একজন বিধর্মী ঈমান গ্রহণ করে এবং তারই জীবনে তা বাস্তবায়নের কারণে
মানুষ হয়ে উঠে আল্লাহ্ মুখী ও তাকওয়াবান। যা আমরা রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর
যুগে এবং তৎপরবর্র্তী যুগে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই। তাই তাকে অবশ্যই কতিপয়
গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে যা দ্বারা মানুষ তার দিকে আকৃষ্ট
হয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে দোযখের কঠিন আযাব থেকে রক্ষা
করতে সক্ষম হবে।
মানবচরিত্রের দু’টি ধারা। একটি মানবচরিত্র
ধ্বংসকারী অসৎ স্বভাবসমূহ ও মানবচরিত্র ধ্বংসের হাত থেকে পরিত্রাণকারী মহৎ
গুণাবলী। এ দু’টি পদ্ধতির মধ্যে মানবচরিত্র ধ্বংসকারী অসৎ স্বভাবসমূহ থেকে
বিরত থেকে মানবচরিত্র ধ্বংসের হাত থেকে পরিত্রাণকারী মহৎ গুণাবলী পালন ও
বাস্তবায়নের মাধ্যমেই একমাত্র মানবচরিত্রকে উন্নতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছতে
সক্ষম হয়। পাশাপাশি এমন কিছু গুণাবলি রয়েছে যেগুলো বর্জন করা মু’মিনের উপর
আবশ্য। আলোচ্য প্রবন্ধে এ প্রসঙ্গেই ধারাবাহিক ভাবে আলোচনা করা হবে।
১. অহংকার
অহংকার পরিচিতি
অহংকার শব্দটির আরবী প্রতিশব্দ হলো : (আল-কিবর)الكِبْر। যার আভিধানিক অর্থ, বড়ত্ব, বড়াই, অহংকার ইত্যাদি। আল্লামা ইব্ন মানযুর রহ. বলেন : (আল-কিবর) الكِبْر শব্দের আভিধানিক অর্থ বড়ত্ব, অহংকার ও দাম্ভিক, অহমিকা ইত্যাদি।১
অহংকারে
র পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রদানে হাদীসে রাসূল সা. বলেন :
عن عبد الله بن مسعود، عن النبي صلى
الله عليه و سلم قال: لا يْدخُلُ الجَنةََّ مَنْ كَانَ فِي قَلْبهِِ
مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كبِرٍ قَالَ رَجُلٌ: إِنَّ الرَّجُلَ يُحبُِّ أَنْ
يَكُونَ ثَوْبُهُ حسَنًا، وَنْعُلُه حَسَنَةً. قَالَ: إِنَّ الله جَميِلٌ
يُحبُ الجَمَالَ، الْكبِر بَطَرُ الحَقِّ، وَغَمْطُ الناَّسِ.
আব্দুল্লাহ ইব্ন মাসুদ রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন :
যার অন্তরে একটি অণু পরিমাণ অহংকার থাকে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
রাসূল সা. এ কথা বললে, এক লোক দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেসা করল : কোন কোন লোক এমন আছে,
সে সুন্দর কাপড় পরিধান করতে পছন্দ করে, সুন্দর জুতা পরিধান করতে পছন্দ
করে, এসবকে কি অহংকার বলা হবে? রাসূল সা. উত্তরে বললেন : আল্লাহ্ তা‘আলা
নিজেই সুন্দর, তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। (সুন্দর কাপড় পরিধান করা অহংকার
নয়) অহংকার হল, সত্যকে গোপন করা এবং মানুষকে নিকৃষ্ট জানা।২ উল্লেখ্য যে, রাসূল সা. এ হাদীসে অহংকারের সংজ্ঞা দু’টি অংশে তুলে ধরেন।
এক. প্রকৃত সত্যকে
অস্বীকার করা। হককে কবুল না করে তার প্রতি অবজ্ঞা করা এবং সত্য কবুল করা
থেকে বিরত থাকা। বর্তমান আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষকে দেখা যায়, যখন তাদের
নিকট এমন কোন লোক হকের দাওয়াত নিয়ে আসে, যে বয়স বা সম্মানের দিক দিয়ে তার
থেকে ছোট, তখন সে তার কথার প্রতি কোন প্রকার গুরুত্ব দেয় না। আর তা যদি
তাদের মতামত অথবা তারা যা নির্ধারণ ও যার উপর তারা আমল করছে, তার পরিপন্থী
হয়, তখন তারা তা অস্বীকার ও প্রত্যাখান করে। আর অধিকাংশ মানুষের স্বভাব হল,
যে লোকটি তাদের নিকট দাওয়াত নিয়ে আসবে, তাকে ছোট মনে করবে এবং তার
বিরোধিতায় অটল ও অবিচল থাকবে, যদিও কল্যাণ নিহিত থাকে সত্য ও হকের
আনুগত্যের মধ্যে এবং তারা যে অন্যায়ের উপর অটুট রয়েছে। তাতে তাদের ক্ষতি
ছাড়া কোনই কল্যাণ না থাকে। আমাদের সমাজে এ ধরণের লোকের অভাব নেই। বিশেষ করে
ছোট পরিসরে এ ধরণের ঘটনা অহরহ ঘটতে থাকে। যেমন : পরিবার, স্কুল,
মাদ্রাসায়, অফিস আদালত ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে এ ধরণের ঘটনা নিত্যদিন ঘটে
থাকে।
অহংকারীরা যে বিষয়টির আশংকা করে অপরের
থেকে সত্যকে গ্রহণ করে না, তাহলো, সে যদি অপর ব্যক্তি থেকে প্রমাণিত সত্যকে
গ্রহণ করে, তাকে মানুষ সম্মান দেবে না, মানুষ অপর লোকটিকে সম্মান দেবে তখন
সম্মান অপরের হাতে চলে যাবে এবং সে মানুষের সামনে বড় ও সম্মানী লোক হিসেবে
বিবেচিত হবে, অহংকারীকে কেউ সম্মান করবে না। এ কারণেই সে কাউকে মেনে নিতে
পারে না, সে মনে করে সত্যকে গ্রহণ করলে তার সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে এবং
মানুষ তার প্রতি আর আকৃষ্ট হবে না। মানুষ সে লোকটিকেই বড় মনে করবে এবং
তাকেই মানবে। আর বাধ্য হয়ে অহংকারীকও অপরের অনুসারী হতে হবে। কিন্তু এ
অহংকারী লোকটি যদি বুঝতে পারত, তার জন্য সত্যিকার ইজ্জত ও সম্মান হল, হকের
অনুসরণ ও আনুগত্য করার মধ্যে, বাতিলের মধ্যে ডুবে থাকতে নয়ত, তা ছিল তার
জন্য অধিক কল্যাণকর ও প্রশংসনীয়।
উমর ইব্নুল খাত্তাব রা. আবূ মূসা আল-আশআরী
রা.-এর নিকট লিখেন, তুমি গত কাল যে ফায়সালা দিয়েছিলে, তার মধ্যে তুমি
চিন্তা ফিকির করে যখন সঠিক ও সত্য তার বিপরীতে পাও, তাহলে তা থেকে ফিরে
আসতে যেন তোমার নফস তোমাকে বাধা না দেয়। কারণ, সত্য চিরন্তন, সত্যের পথে
ফিরে আসা বাতিলের মধ্যে সময় নষ্ট করার চেয়ে অনেক উত্তম।৩
আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী রহ. বলেন : একদা
আমরা একটি জানাযায় উপস্থিত হলাম, তাতে কাজী উবায়দুল্লাহ ইব্নুল হাসান রহ.
হাজির হল। আমি তাকে একটি বিষয়ে জিজ্ঞেসা করলে, সে ভুল উত্তর দেয়, আমি তাকে
বললাম : আল্লাহ্ আপনাকে সংশোধন করে দিক, এ মাসআলার সঠিক উত্তর এভাবে …।
তিনি কিছু সময় মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকলেন, তারপর মাথা উঠিয়ে বললেন :
আমি আমার কথা থেকে ফিরে আসলাম, আমি লজ্জিত। সত্য গ্রহণ করে লেজ হওয়া আমার
নিকট মিথ্যার মধ্যে থেকে মাথা হওয়ার চেয়ে অধিক উত্তম।৪
দুই. মানুষকে নিকৃষ্ট
জানা। মনে রাখতে হবে যে, যারা মানুষকে খারাপ জানে, তাদের কর্মের পরিণতি হল,
মানুষ তাদের খারাপ জানবে। এ ধরণের লোকেরা মানুষের সুনামকে ক্ষুন্ন এবং
তাদের যোগ্যতাকে ম্লান করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। সে অন্যদের উপর তার নিজের
বড়ত্ব ও উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার লক্ষ্যে, মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন ও ছোট
করে। মানুষের সম্মানহানি ঘটানোর উদ্দেশ্যে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে ও
অপবাদ রটায়। অহংকারীরা কখনোই মানুষের চোখে ভাল হতে পারে না, মানুষ তাদের
ভালো চোখে দেখে না। অহংকারী তার নিজের কর্ম ও গুণ দিয়ে কখনোই উচ্চ মর্যাদা
বা সম্মান লাভ করতে সক্ষম হয় না। তাই সে নিজে সম্মান লাভ করতে না পেরে
নিজের মর্যাদা ঠিক রাখার জন্য অন্যদের কৃতিত্বকে নষ্ট করে এবং তাদের
মান-মর্যাদা খাট করে দেখে।
আবূ ওহাব আল-মারওয়ারজি রহ. বলেন : আমি
আব্দুল্লাহ্ ইব্ন মুবারককে জিজ্ঞেসা করলাম : কিবর কী? উত্তরে তিনি বললেন :
মানুষকে অবজ্ঞা করা। তারপর আমি তাকে উজব সম্পর্কে জিজ্ঞেসা করলাম : উজব কী?
উত্তরে তিনি বললেন : তুমি মনে করলে যে, তোমার নিকট এমন কিছু আছে, যা
অন্যদের মধ্যে নেই। তিনি বললেন : নামাজিদের মধ্যে উজব বা আত্মতৃপ্তির চেয়ে
খারাপ আর কোন মারাত্মক ত্রুটি আমি দেখতে পাই না।৫
অহংকারের শ্রেণীবিভাগ ও স্তরসমূহ
প্রকাশ থাকে যে, অহংকার দুই প্রকার। এক. কিবরে জাহির (প্রকাশ্য অহংকার) দুই. কিবরে বাতিন (অপ্রকাশ্য অহংকার)
এক. প্রকাশ্য অহংকার :
প্রকাশ অহংকার দ্বারা বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও কাজের মাধ্যমে যে কিবর বা
অহংকার প্রকাশ পায় তাকে কিবরে জাহির বা প্রকাশ্য অহংকার বলে।
দুই. অপ্রকাশ্য অহংকার :
নিজেকে অপরের চেয়ে মর্যাদায় বড় ধারণা করাতে অন্তরে যে এক সন্তুষ্টির হালত
আসে উক্ত হালতকে কিবরে বাতিন বা অপ্রকাশ্য অহংকার বলে। উল্লেখ্য যে, কিবরে
জাহির ছোটদের সামনে করা জায়িয কিন্তু বড়দের সামনে করা নাজায়িয।
অহংকারের স্তর
প্রকাশ থাকে যে, অহংকারের স্তর তিনটি। যথা :
এক. আল্লাহর সাথে : যেমন-নমরূদ, ফির‘আউন ও ইবলীসের তাকাব্বুরী।
দুই. রাসূল সা. এর সাথে :
যেমন-কুফ্ফারে কুরাইশরা বলেছিল তারা ইয়াতীম মুহাম্মদের কাছে মাথা নত করতে
পারবে না। তাদের সর্দারদেরকে কেন রাসূল করা হলো না?
তিন. রাসূল ব্যতীত অন্যান্য লোকদের সাথে। যেটি আমাদের সমাজে প্রচলিত।
অহংকারের কারণসমূহ
একজন অহংকারী মনে করে সে তার সাথী
সঙ্গীদের চেয়ে জাতিগত ও সত্তাগতভাবেই বড় এবং সে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র,
তার সাথে কারো কোন তুলনা হয় না। ফলে সে কাউকেই কোন প্রকার তোয়াক্কা করে না,
কাউকে মূল্যায়ন করতে চায় না এবং কারো আনুগত্য করার মানসিকতা তার মধ্যে
থাকে না। যার কারণে সে সমাজে এমনভাবে চলা ফেরা করে মনে হয় তার মত এত বড় আর
কেউ নেই। এ অহংকারের কতগুলো কারণ নিম্নরূপ :
এক. কারো প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করা
অহংকার প্রবেশের অন্যতম কারণ হলো কারোর
প্রতি নমনীয় না হওয়া বা আনুগত্য না করার স্পৃহা। সে চিন্তা করে আমি কেন
মানুষের কথা শুনবো। মানুষ আমার কথা শুনবে। আমিই মানুষকে উপদেশ দিব। এভাবেই
তার দিন অতিবাহিত হতে থাকে। আর অহংকারের স্পৃহা বাড়তে থাকে। এ প্রসঙ্গে
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :
كَلَّا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَى . أَنْ رَآهُ اسْتَغْنَى . إِنَّ إِلَى رَبِّكَ الرُّجْعَى .
“কখনও নয়, নিশ্চয়ই মানুষ সীমালঙ্ঘন করে থাকে। কেননা সে নিজেকে মনে করে স্বয়ংসম্পূর্ণ। নিশ্চয়ই তোমার রবের দিকেই প্রত্যাবর্তন।৬
আল্লামা বাগাভী রহ. বলেন : মানুষ তখনই
সীমালঙ্ঘন এবং তার প্রভুর বিরুদ্ধাচারণ করে, যখন সে দেখতে পায়, সে নিজেই
স্বয়ংসম্পন্ন। আর কারো প্রতি নত হওয়া বা কারো আনুগত্য করার কোন প্রয়োজন
নেই।৭
দুই. প্রভাব বিস্তার করার অভিলাস
একজন অহংকারী সে মনে করে, সমাজে তার
প্রাধান্য বিস্তার, সবার নিকট প্রসিদ্ধি লাভ ও নেতৃত্ব দেয়ার কোন বিকল্প
নেই। তাকে এ লক্ষ্যে সফল হতেই হবে কিন্তু যদি সমাজ তার কর্তৃত্ব বা
প্রাধান্য মেনে না নেয়, তখন সে চিন্তা করে, তাকে যে কোন উপায়ে তার অভীষ্ট
লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। চাই তা বড়াই করে হোক অথবা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে
হোক। তখন সে যা ইচ্ছা তাই করে এবং সমাজে হট্রোগল শুরু করে।
তিন. দোষ-গুণ গোপন করা
একজন অহংকারী ইচ্ছা করলে তার দোষগুণগুলো
বিনয়, নম্রতা, মানুষের সাথে বন্ধুত্ব ও চুপ-চাপ থাকার মাধ্যমে গোপন রাখতে
পারত, কিন্তু তা না করে অহংকার করার কারণে তার সব গোমর ফাঁক হয়ে যায়। এ
ছাড়াও মানুষ যা পছন্দ করে না, তা নিয়ে দু:খ প্রকাশ করা, কোন বিষয়ে
চ্যালেঞ্জ করা হতে দূরে থাকা এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য মিথ্যা দাবি করা
হতে বিরত থাকার মাধ্যমে সে তার যাবতীয় দুর্বলতা ও গোপন বিষয়গুলো ধামা চাপা
দিতে পারত কিন্তু সে তা না করে অহংকার করাতে তার অবস্থা আরও প্রতিকূলে গেল
এবং ফলাফল তার বিপক্ষে চলে গেল। তার বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে তার যাবতীয়
অপকর্ম মানুষ জানতে পারল।
চার. অপরকে সম্মান করতে না জানা
মানুষ শ্রেষ্ঠ হওয়ার মানদণ্ড কী এবং
মানুষকে কীসের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে, তা আমাদের অবশ্যই জানা থাকতে
হবে। অহংকারের অন্যতম কারণ হলো : মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড নিধারণে
ত্র“টি করা। একজন মানুষের শ্রেষ্ঠ হওয়ার মানদণ্ড কি তা আমাদের অনেকেরই
অজানা। রাসূল সা. তাঁর সাহাবীদের একটি সুস্পষ্ট ও বাস্তব দৃষ্টান্ত দিয়ে
বুঝিয়ে দেন যে, একজন মানুষকে কিসের ভিত্তিতে মূল্যায়ন ও অগ্রাধিকার দেয়া
হবে এবং তাকে কিসের ভিত্তিতে অবমূল্যায়ন ও পিছনে ফেলে রাখা হবে। মানুষের
মর্যাদা তার পোশাকে নয়, বরং মানুষের মর্যাদা তার অন্তর্নিহীত সততা,
স্বচ্ছতা ও আল্লাহ্ ভীতির উপর নির্ভর করে। যার মধ্যে যতটুকু আল্লাহ্ ভীতি
থাকবে, সে তত বেশি সৎ ও উত্তম লোক হিসেবে বিবেচিত হবে। এ প্রসঙ্গে
রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেন :
عن سهل بن سعد الساعدي قال : مَرَّ
رجل على رسول الله صلى الله عليه و سلم فقال مَا تَقُولُونَ فِي هَذَا
قالوا حِرٌّي إن خطب أَنْ ينكح وَإن شفع أن يُشَفَّعَ، وإن قال أَنْ
يْسَتَمعَ، قال ثم سكت، فَمَرّ رجل من فقراء المسلمين، فقال مَاتَقُولُونَ
فِي هَذَا قالواحِرٌّي إنْ خطب أن لا ينكح و َإِنْ شفع أَنْ لَا يُشَفَّعَ،
وإن قال أَنْ لَا يْسَتَمعَ، فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم هَذَا
خَيٌر مِنْ مِلِْء الْأرَْضِ مِثْلَ هَذَا.
সাহাল ইব্ন সাদ রা. হতে বর্ণিত;
তিনি বলেন : একদিন রাসূল সা. এর সামনে দিয়ে একব্যক্তি অতিক্রম করে
যাচ্ছিল, রাসূল সা. সমবেত লোকদের জিজ্ঞেসা করলেন, তোমরা এ লোকটি সম্পর্কে
কী বল? তারা উত্তরে বলল : লোকটি যদি কাউকে বিবাহের প্রস্তাব দেয় তাহলে তার
ডাকে সাড়া দেয়া হয়, যদি কারো বিষয়ে সুপারিশ করে, তাহলে তার সুপারিশ গ্রহণ
করা হয়, আর যদি কোন কথা বলে, তার কথা শোনা হয়। তাদের কথা শুনে রাসূল সা.
চুপ করে থাকেন। একটু পর অপর একজন দরিদ্র মুসলিম রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করে
যাচ্ছিল। রাসূল সা. তাকে দেখে বললেন : তোমরা এ লোকটি সম্পর্কে কী বল? তারা
বলল : যদি সে প্রস্তাব দেয়, তাহলে তার প্রস্তাবে সাড়া দেয়া হয় না, কোন
সুপারিশ করলে তা গ্রহণ করা হয় না, আর যদি সে কোন কথা বলে তার কথায় কোন কান
দেয়া হয় না। তখন রাসূল সা. বললেন : এ লোকটি যমিনে ভরপুর যত কিছু আছে তার
সবকিছুর চেয়ে উত্তম।৮
পাঁচ. আল্লাহকে ভুলে যাওয়া
কিবর বা অহংকারের অন্যতম কারণ হলো, একজন
মানুষকে আল্লাহ্ তা‘আলা যে সব নিয়ামত দান করেছেন, সে সব নিয়ামতকে ঐ লোকের
সাথে তুলনা করা যাকে আল্লাহ্ তা‘আলা কোন হিকমতের কারণে ঐ সব নিয়ামতসমূহ
দেয়নি। তখন সে মনে করে, আমি তো ঐ সব নিয়ামতসমূহ লাভের যোগ্য ও উপযুক্ত
ব্যক্তি, তাই আল্লাহ্ আমাকে আমার যোগ্যতার দিক বিবেচনা করেই নিয়ামতসমূহ দান
করেছেন। ফলে সে নিজেকে সব সময় বড় করে দেখে এবং অন্যদের ছোট করে দেখে ও
নিকৃষ্ট মনে করে। অন্যদেরকে সে মনে করে তারা নিয়ামত লাভের উপযুক্ত নয়,
তাদের যদি যোগ্যতা থাকতো তাহলে আল্লাহ্ তাদের অবশ্যই নিয়ামতরাজী দান করতেন।
অহংকারের নিদর্শনসমূহ
অহংকারের অনেক আলামত রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
ক. আল্লাহর হুকুম বিনা প্রতিবাদে মানতে মনে চায় না।
খ. ধম বিরোধী কাজ করতে অন্তরে ভয় না হওয়া।
গ. নায়েবে রাসূলদের অনুসরণ করতে মনে না চাওয়া।
ঘ. হক ফতোয়া মানতে অন্তরে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়া।
ঙ. মুসলমানদের দেয়া হাদিয়া কবুল না করাও অহংকারের আলামত হিসেবে গণ্য।
চ. নিজেকে ছোট ধারণায় না আনাও অহংকারের আলামতের শামিল।
ছ. ক্ষুদ্র কাজ করতে লজ্জাবোধ করা।
জ. গরীব লোকদেরকে নিকটে বসতে না দেয়া।
ঝ. কাউকে সালাম না দেয়া। উল্লেখ্য যে, সালাম না দেয়া যদিও তাকাব্বুরীর লক্ষণ কিন্তু ধর্ম বিরোধী কাফিরদের বেলায় তা প্রযোজ্য নয়।
ঞ. কেউ উপদেশ দিলে সেদিকে মনোযোগ সহকারে না শুনা।
ট. অপরের সাথে দেখা-সাক্ষাত না করা।
ঠ. সাধারণ লোকদেরকে ইতর জীবের মত মনে করা।
ড. অন্যকে অবজ্ঞার চোখে দেখা।৯
বর্তমান যামানায় সামান্য কিছু লেখা পড়া
করলেই সাংসারিক কাজ নিজের হাতে করাটাকে লজ্জাবোধ মনে করে। এটি একমাত্র
অহংকারের চিহৃ ছাড়া আর কিছুই নয়। কতক পীর (ইলমে তাসাওউফ ও কিতাবী শর্তবিহীন
নাকেছ পীর) এবং কতক আলিমগণের মধ্যে এই প্রকার অহংকার খুব প্রবল আকারে দেখা
যায়। অথচ রাসূল সা. নিজের সাংসারিক কাজ এমনকি স্ত্রীদের সাথে রান্নার
কাজেও সহযোগিতা করতেন বলে বহু সহীহ হাদীসে প্রমাণিত।
এছাড়া তিনি নিজে উট ও ছাগলকে খাদ্য ও পানি
খাওয়াতেন, দুধ দোহন করেছেন, বাজার হতে সদায় ক্রয় করে আনতেন, ঘরে ঝাড়–
দিতেন, মেহমানকে নিজ হাতে খাদিম দিয়ে খাওয়াতেন, নিজের হাতে নিজের কাপড় ধৌত
করতেন। এভাবে অনেক সাংসারিক কাজ রাসূল সা. নিজ হাতেই সম্পাদন করতেন যা
আমাদের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়।
পূর্ববর্তী নবীদের সময়কার অহংকারী
আলোচ্য নিবন্ধে যে সব অহংকারীকে তার অহংকার হকের অনুকরণ ও অনুসরণ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে তাদের দৃষ্টান্ত সম্পর্কে আলোচনা করা হবে:
এক. ইবলিস
অভিশপ্ত ইবলিসের কুফরী করা ও আল্লাহর
আদেশের অবাধ্য হওয়ার একমাত্র কারণ তার অহংকার। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা
মহাগ্রন্থ আল-কুর’আনে ঘোষণা করেন :
إِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ
إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ طِينٍ . فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ
فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ . فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ
كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ . إِلَّا إِبْلِيسَ اسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ
الْكَافِرِينَ . قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا
خَلَقْتُ بِيَدَيَّ أَسْتَكْبَرْتَ أَمْ كُنْتَ مِنَ الْعَالِينَ . قَالَ
أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ .
قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ . وَإِنَّ عَلَيْكَ لَعْنَتِي
إِلَى يَوْمِ الدِّينِ . قَالَ رَبِّ فَأَنْظِرْنِي إِلَى يَوْمِ
يُبْعَثُونَ . قَالَ فَإِنَّكَ مِنَ الْمُنْظَرِينَ . إِلَى يَوْمِ
الْوَقْتِ الْمَعْلُومِ . قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَأُغْوِيَنَّهُمْ
أَجْمَعِينَ . إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ . قَالَ
فَالْحَقُّ وَالْحَقَّ أَقُولُ . لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنْكَ وَمِمَّنْ
تَبِعَكَ مِنْهُمْ أَجْمَعِينَ . قُلْ مَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ
أَجْرٍ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُتَكَلِّفِينَ . إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ
لِلْعَالَمِينَ.
“স্মরণ কর,
যখন তোমার রব ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন : আমি মাটি হতে মানুষ সৃষ্টি
করব। যখন আমি তাকে সুষম করব এবং তার মধ্যে আমার রূহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা
তার উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে যাও’। ফলে ফেরেশতাগণ সকলেই সিজদাবনত হল। ইবলীস
ছাড়া, সে অহংকার করল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ল। আল্লাহ বললেন, ‘হে
ইবলীস! আমার দু’হাতে আমি যাকে সৃষ্টি করেছি তার প্রতি সিজদাবনত হতে কিসে
তোমাকে বাধা দিল? তুমি কি অহংকার করলে, না তুমি অধিকতর উচ্চ
মর্যাদাসম্পন্ন?’ সে বলল : ‘আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে সৃষ্টি
করেছেন অগ্নি থেকে আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে।’ তিনি বললেন, ‘তুমি
এখান থেকে বের হয়ে যাও। কেননা নিশ্চয় তুমি বিতাড়িত। আর নিশ্চয় বিচার দিবস
পর্যন্ত তোমার প্রতি আমার লা‘নত বলবৎ থাকবে। সে বলল : ‘হে আমার রব, আমাকে
সে দিন পর্যন্ত অবকাশ দিন যেদিন তারা পুনরুত্থিত হবে।’ তিনি বললেন, আচ্ছা
তুমি অবকাশপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হলে-‘নির্ধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন
পর্যন্ত।’ সে বলল : ‘আপনার ইজ্জতের কসম! আমি তাদের সকলকেই বিপথগামী করে
ছাড়ব।’ তাদের মধ্য থেকে আপনার একনিষ্ঠ বান্দারা ছাড়া। আল্লাহ বললেন : এটি
সত্য আর সত্য-ই আমি বলি’ তোমাকে দিয়ে এবং তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ
করত তাদের দিয়ে নিশ্চয় আমি জাহান্নাম পূর্ণ করব। বল, ‘এর বিনিময়ে আমি
তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না আর আমি ভানকারীদের অন্তর্ভুক্ত নই।
সৃষ্টিকুলের জন্য এ তো উপদেশ ছাড়া আর কিছু নয়।”১০
দুই. ফির‘আউন ও তার সম্প্রদায়ের লোক
অনুরূপভাবে ফির‘আউনের কুফরী করার কারণ ছিল, তার অহংকার। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :
وَقَالَ فِرْعَوْنُ يَا أَيُّهَا
الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرِي فَأَوْقِدْ لِي يَا
هَامَانُ عَلَى الطِّينِ فَاجْعَلْ لِي صَرْحًا لَعَلِّي أَطَّلِعُ إِلَى
إِلَهِ مُوسَى وَإِنِّي لَأَظُنُّهُ مِنَ الْكَاذِبِينَ . وَاسْتَكْبَرَ
هُوَ وَجُنُودُهُ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَظَنُّوا أَنَّهُمْ
إِلَيْنَا لَا يُرْجَعُونَ . فَأَخَذْنَاهُ وَجُنُودَهُ فَنَبَذْنَاهُمْ
فِي الْيَمِّ فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الظَّالِمِينَ .
وَجَعَلْنَاهُمْ أَئِمَّةً يَدْعُونَ إِلَى النَّارِ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ
لَا يُنْصَرُونَ . وَأَتْبَعْنَاهُمْ فِي هَذِهِ الدُّنْيَا لَعْنَةً
وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ هُمْ مِنَ الْمَقْبُوحِينَ.
আর ফির‘আউন
বলল : ‘হে পারিষদবর্গ, আমি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ আছে বলে আমি জানি না।
অতএব হে হামান! আমার জন্য তুমি ইট পোড়াও, তারপর আমার জন্য একটি প্রাসাদ
তৈরী কর। যাতে আমি মূসার ইলাহকে দেখতে পাই। আর নিশ্চয় আমি মনে করি সে
মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত’। আর ফির‘আউন ও তার সেনাবাহিনী অন্যায়ভাবে যমীনে
অহংকার করেছিল এবং তারা মনে করেছিল যে, তাদেরকে আমার নিকট ফিরিয়ে আনা হবে
না। অতঃপর আমি তাকে ও তার সেনাবাহিনীকে পাকড়াও করলাম, তারপর তাদেরকে
সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম। অতএব, দেখ যালিমদের পরিণাম কিরূপ হয়েছিল? আর আমি
তাদেরকে নেতা বানিয়েছিলাম, তারা জাহান্নামের দিকে আহ্বান করত এবং কিয়ামতের
দিন তাদেরকে সাহায্য করা হবে না। এ যমীনে আমি তাদের পিছনে অভিসম্পাত লাগিয়ে
দিয়েছি আর কিয়ামতের দিন তারা হবে ঘৃণিতদের অন্তর্ভুক্ত।১১
তিন. সালেহ আ.-এর কওম সামূদ গোত্র
সামূদ গোত্রের কুফরীর কারণও একই। অর্থাৎ তাদের অহংকার। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :
قَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ
اسْتَكْبَرُوا مِنْ قَوْمِهِ لِلَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا لِمَنْ آمَنَ
مِنْهُمْ أَتَعْلَمُونَ أَنَّ صَالِحًا مُرْسَلٌ مِنْ رَبِّهِ قَالُوا
إِنَّا بِمَا أُرْسِلَ بِهِ مُؤْمِنُونَ . قَالَ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا
إِنَّا بِالَّذِي آمَنْتُمْ بِهِ كَافِرُونَ . فَعَقَرُوا النَّاقَةَ
وَعَتَوْا عَنْ أَمْرِ رَبِّهِمْ وَقَالُوا يَا صَالِحُ ائْتِنَا بِمَا
تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الْمُرْسَلِينَ . فَأَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ
فَأَصْبَحُوا فِي دَارِهِمْ جَاثِمِينَ.
“তার কওমের
অহংকারী নেতৃবৃন্দ তাদের সেই মু’মিনদেরকে বলল যাদেরকে দুর্বল মনে করা হত,
‘তোমরা কি জান যে, সালিহ তার রবের পক্ষ থেকে প্রেরিত’? তারা বলল : ‘নিশ্চয়
সে যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছে, আমরা তাতে বিশ্বাসী’। যারা অহংকার করেছিল তারা
বলল : ‘নিশ্চয় তোমরা যার প্রতি ঈমান এনেছ, আমরা তার প্রতি অস্বীকারকারী’।
অতঃপর তারা উষ্ট্রীকে যবেহ করল এবং তাদের রবের আদেশ অমান্য করল। আর তারা
বলল : ‘হে সালিহ! তুমি আমাদেরকে যে ওয়াদা দিয়েছ, তা আমাদের কাছে নিয়ে এসো,
যদি তুমি রাসূলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাক’। ফলে তাদেরকে ভূমিকম্প পাকড়াও করল,
তাই সকালে তারা তাদের গৃহে উপুড় হয়ে মরে রইল।”১২
চার. হুদ আ.-এর কাওম আদ সম্প্রদায়
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :
فَأَمَّا عَادٌ فَاسْتَكْبَرُوا فِي
الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَقَالُوا مَنْ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةً
أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَهُمْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُمْ
قُوَّةً وَكَانُوا بِآيَاتِنَا يَجْحَدُونَ . فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ
رِيحًا صَرْصَرًا فِي أَيَّامٍ نَحِسَاتٍ لِنُذِيقَهُمْ عَذَابَ الْخِزْيِ
فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلَعَذَابُ الْآخِرَةِ أَخْزَى وَهُمْ لَا
يُنْصَرُونَ . وَأَمَّا ثَمُودُ فَهَدَيْنَاهُمْ فَاسْتَحَبُّوا الْعَمَى
عَلَى الْهُدَى فَأَخَذَتْهُمْ صَاعِقَةُ الْعَذَابِ الْهُونِ بِمَا
كَانُوا يَكْسِبُونَ . وَنَجَّيْنَا الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا
يَتَّقُونَ .
“আর ‘আদ
সম্প্রদায়, তারা যমীনে অযথা অহংকার করত এবং বলত, ‘আমাদের চেয়ে অধিক
শক্তিশালী কে আছে’? তবে কি তারা লক্ষ্য করেনি যে, নিশ্চয় আল্লাহ যিনি
তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী? আর তারা আমার আয়াতগুলোকে
অস্বীকার করত। তারপর আমি তাদের উপর অশুভ দিনগুলোতে ঝঞ্ঝাবায়ু পাঠালাম যাতে
তাদেরকে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনাদায়ক আযাব আস্বাদন করাতে পারি। আর আখিরাতের
আযাব তো অধিকতর লাঞ্ছনাদায়ক এবং তাদেরকে সাহায্য করা হবে না। আর সামূদ
সম্প্রদায়, আমি তাদেরকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিয়েছিলাম; কিন্তু তারা সঠিক
পথে চলার পরিবর্তে অন্ধ পথে চলাই পছন্দ করেছিল। ফলে তাদের অর্জনের কারণেই
লাঞ্ছনাদায়ক আযাবের বজ্রাঘাত তাদেরকে পাকড়াও করল। আর আমি তাদেরকে রক্ষা
করলাম যারা ঈমান এনেছিল এবং তাকওয়া অবলম্বন করত।”১৩
পাঁচ. শু‘আইব আ.-এর কওম মাদায়েনবাসী
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন :
قَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ
اسْتَكْبَرُوا مِنْ قَوْمِهِ لَنُخْرِجَنَّكَ يَا شُعَيْبُ وَالَّذِينَ
آمَنُوا مَعَكَ مِنْ قَرْيَتِنَا أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا قَالَ
أَوَلَوْ كُنَّا كَارِهِينَ . قَدِ افْتَرَيْنَا عَلَى اللَّهِ كَذِبًا
إِنْ عُدْنَا فِي مِلَّتِكُمْ بَعْدَ إِذْ نَجَّانَا اللَّهُ مِنْهَا وَمَا
يَكُونُ لَنَا أَنْ نَعُودَ فِيهَا إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّنَا
وَسِعَ رَبُّنَا كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا عَلَى اللَّهِ تَوَكَّلْنَا رَبَّنَا
افْتَحْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ قَوْمِنَا بِالْحَقِّ وَأَنْتَ خَيْرُ
الْفَاتِحِينَ . وَقَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَوْمِهِ
لَئِنِ اتَّبَعْتُمْ شُعَيْبًا إِنَّكُمْ إِذًا لَخَاسِرُونَ .
فَأَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ فَأَصْبَحُوا فِي دَارِهِمْ جَاثِمِينَ .
الَّذِينَ كَذَّبُوا شُعَيْبًا كَأَنْ لَمْ يَغْنَوْا فِيهَا الَّذِينَ
كَذَّبُوا شُعَيْبًا كَانُوا هُمُ الْخَاسِرِينَ.
“তার কওম
থেকে যে নেতৃবৃন্দ অহংকার করেছিল তারা বলল : ‘হে শু‘আইব, আমরা তোমাকে ও
তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে অবশ্যই আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেব
অথবা তোমরা আমাদের ধর্মে ফিরে আসবে।’ সে বলল : ‘যদিও আমরা অপছন্দ করি
তবুও?’ আমরা তো আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করলাম যদি আমরা তোমাদের ধর্মে ফিরে
যাইÑ সেই ধর্ম থেকে আল্লাহ আমাদেরকে নাজাত দেয়ার পর। আর আমাদের জন্য উচিত
হবে না তাতে ফিরে যাওয়া। তবে আমাদের রব আল্লাহ চাইলে (সেটা ভিন্ন কথা)।
আমাদের রব জ্ঞান দ্বারা সব কিছু পরিব্যাপ্ত করে আছেন। আল্লাহরই উপর আমরা
তাওয়াক্কুল করি। হে আমাদের রব! আমাদের ও আমাদের কওমের মধ্যে যথার্থ ফায়সালা
করে দিন। আর আপনি শ্রেষ্ঠ ফয়সালাকারী। আর তার কওম থেকে যে নেতৃবৃন্দ কুফরী
করেছিল তারা বলল : ‘যদি তোমরা শু‘আইবকে অনুসরণ কর তাহলে নিশ্চয় তোমরা
ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ অতঃপর ভূমিকম্প তাদের পাকড়াও করল। তারপর তারা তাদের গৃহে
উপুড় হয়ে মরে রইল। যারা শু‘আইবকে মিথ্যাবাদী বলেছিল, মনে হয় যেন তারা
সেখানে বসবাসই করেনি। যারা শু‘আইবকে মিথ্যাবাদী বলেছিল তারাই ছিল
ক্ষতিগ্রস্ত।”১৪
ছয়. নূহ আ.-এর সম্প্রদায়
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :
قَالَ رَبِّ إِنِّي دَعَوْتُ
قَوْمِي لَيْلًا وَنَهَارًا . فَلَمْ يَزِدْهُمْ دُعَائِي إِلَّا فِرَارًا .
وَإِنِّي كُلَّمَا دَعَوْتُهُمْ لِتَغْفِرَ لَهُمْ جَعَلُوا أَصَابِعَهُمْ
فِي آذَانِهِمْ وَاسْتَغْشَوْا ثِيَابَهُمْ وَأَصَرُّوا وَاسْتَكْبَرُوا
اسْتِكْبَارًا . ثُمَّ إِنِّي دَعَوْتُهُمْ جِهَارًا . ثُمَّ إِنِّي
أَعْلَنْتُ لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَارًا . فَقُلْتُ
اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا.
“সে বলল :
‘হে আমার রব! আমি তো আমার কওমকে রাত-দিন আহবান করেছি। ‘অতঃপর আমার আহ্বান
কেবল তাদের পলায়নই বাড়িয়ে দিয়েছে’। ‘আর যখনই আমি তাদেরকে আহ্বান করেছি ‘যেন
আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন’, তারা নিজদের কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছে,
নিজদেরকে পোশাকে আবৃত করেছে, (অবাধ্যতায়) অনড় থেকেছে এবং দম্ভভরে ঔদ্ধত্য
প্রকাশ করেছে’। ‘তারপর আমি তাদেরকে প্রকাশ্যে আহ্বান করেছি’। অতঃপর তাদেরকে
আমি প্রকাশ্যে এবং অতি গোপনেও আহ্বান করেছি। আর বলেছি, ‘তোমাদের রবের কাছে
ক্ষমা চাও; নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল’।”১৫
পরবর্তীতে তাদের শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
مِمَّا خَطِيئَاتِهِمْ أُغْرِقُوا
فَأُدْخِلُوا نَارًا فَلَمْ يَجِدُوا لَهُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْصَارًا
. وَقَالَ نُوحٌ رَبِّ لَا تَذَرْ عَلَى الْأَرْضِ مِنَ الْكَافِرِينَ
دَيَّارًا . إِنَّكَ إِنْ تَذَرْهُمْ يُضِلُّوا عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوا
إِلَّا فَاجِرًا كَفَّارً.
“তাদের
পাপের কারণে তাদেরকে ডুবিয়ে দেয়া হল অতঃপর আগুনে প্রবেশ করানো হল; তারা
নিজদের সাহায্যকারী হিসেবে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে পায়নি। আর নূহ বলল : ‘হে
আমার রব! যমীনের উপর কোন কাফিরকে অবশিষ্ট রাখবেন না’। ‘আপনি যদি তাদেরকে
অবশিষ্ট রাখেন তবে তারা আপনার বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করবে এবং দুরাচারী ও
কাফির ছাড়া অন্য কারো জন্ম দেবে না’।”১৬
সাত. বনী ইসরাঈল
এ প্রসেঙ্গ আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :
وَلَقَدْ آتَيْنَا مُوسَى
الْكِتَابَ وَقَفَّيْنَا مِنْ بَعْدِهِ بِالرُّسُلِ وَآتَيْنَا عِيسَى
ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ
أَفَكُلَّمَا جَاءَكُمْ رَسُولٌ بِمَا لَا تَهْوَى أَنْفُسُكُمُ
اسْتَكْبَرْتُمْ فَفَرِيقًا كَذَّبْتُمْ وَفَرِيقًا تَقْتُلُونَ .
وَقَالُوا قُلُوبُنَا غُلْفٌ بَلْ لَعَنَهُمُ اللَّهُ بِكُفْرِهِمْ
فَقَلِيلًا مَا يُؤْمِنُونَ . وَلَمَّا جَاءَهُمْ كِتَابٌ مِنْ عِنْدِ
اللَّهِ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَهُمْ وَكَانُوا مِنْ قَبْلُ يَسْتَفْتِحُونَ
عَلَى الَّذِينَ كَفَرُوا فَلَمَّا جَاءَهُمْ مَا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ
فَلَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الْكَافِرِينَ . بِئْسَمَا اشْتَرَوْا بِهِ
أَنْفُسَهُمْ أَنْ يَكْفُرُوا بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ بَغْيًا أَنْ
يُنَزِّلَ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ عَلَى مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ
فَبَاءُوا بِغَضَبٍ عَلَى غَضَبٍ وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ مُهِينٌ .
“যার
বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে তা কত জঘন্য (তা এই) যে, আল্লাহ্ যা
নাযিল করেছেন তা তারা অস্বীকার করেছে এই জিদের বশবর্তী হয়ে যে, আল্লাহ্
তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তার উপর তাঁর অনুগ্রহ নাযিল করেছেন।
সুতরাং তারা ক্রোধের উপর ক্রোধের অধিকারী হল। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে
লাঞ্ছনাকর আযাব। আর তারা বলল : আমাদের অন্তরসমূহ আচ্ছাদিত; বরং তাদের
কুফরীর কারণে আল্লাহ্ তাদেরকে লা‘নত করেছেন। অতঃপর তারা খুব কমই ঈমান আনে।
আর যখন তাদের কাছে, তাদের সাথে যা আছে, আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তার সত্যায়নকারী
কিতাব এলো, আর তারা (এর মাধ্যমে) পূর্বে কাফিরদের উপর বিজয় কামনা করত।
সুতরাং যখন তাদের নিকট এলো যা তারা চিনত, তখন তারা তা অস্বীকার করল। অতএব
কাফিরদের উপর আল্লাহ্র লা‘নত। আর আমি নিশ্চয় মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার
পরে একের পর এক রাসূল প্রেরণ করেছি এবং মারইয়াম পুত্র ঈসাকে দিয়েছি
সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ। আর তাকে শক্তিশালী করেছি ‘পবিত্র আত্মা’র মাধ্যমে।
তবে কি তোমাদের নিকট যখনই কোন রাসূল এমন কিছু নিয়ে এসেছে, যা তোমাদের
মনঃপূত নয়, তখন তোমরা অহংকার করেছ, অতঃপর (নবীদের) একদলকে তোমরা মিথ্যাবাদী
বলেছ আর একদলকে হত্যা করেছ।”১৭
এমনিভাবে মহান আল্লাহ্ অহংকারীদের অহংকার ভেঙ্গে চুরে দাবিয়ে দেন।
অহংকারের শাস্তি
নিজেকে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ
জ্ঞান করা, অন্যদেরকে নিজের তুলনায় ছোট ও অধম মনে করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা,
আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে ঔদ্ধ্যত প্রকাশ করে তার প্রতি অবাধ্য হওয়া ও আদেশ
অমান্য করা সবই অহংকারের লক্ষণ ও অহংকারের মধ্যে গণ্য। আল কুরআনে বহু
জায়গায় অহংকারের নিন্দা ও অহংকারীর প্রতি ধিক্কার ঘোষিত হয়েছে। আল্লাহ
তা‘আলা বলেন :
وَقَالَ مُوسَى إِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُمْ مِنْ كُلِّ مُتَكَبِّرٍ لَا يُؤْمِنُ بِيَوْمِ الْحِسَابِ.
“মূসা বললো
: আমি আমার ও তোমাদের প্রতিপালকের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এমন প্রত্যেক
অহংকারী থেকে, যে হিসাবের দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে না।”১৮
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা অন্য এক আয়াতে বলেন :
إنه لا يحب المستكبرين.
“নিশ্চয় আল্লাহ অহংকারীদেরকে পছন্দ করেন না।”১৯
এ দ্বারা বুঝা গেল, আল্লাহর প্রতি তার
ঈমান থাকলেও তাতে কোন লাভ হবে না। ইবলিসের ন্যায় সে কাফের বলে গণ্য হবে।
লুকমান আ. তার ছেলেকে উপদেশ দিতে যেয়ে যে কথা বলেছিলেন তা আল্লাহ্ তা‘আলা
এত বেশি পছন্দ করেছিলেন যে, আল্লাহ্ তা কুর’আনে উল্লেখ করে দিয়েছেন। হাদীসে
কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “অহংকার আমার পোশাক। এই পোশাক যে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেষ্টা করে, তাকে আমি জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো।”২০
রাসূল (সা.) আরো বলেন : যে
ব্যক্তি অহংকারের সাথে চলাফেরা করে এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, সে যখন
আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাত করবে, তখন তাঁকে তার ওপর রাগান্বিত দেখবে।”২১
অপর একটি হাদীসে এসেছে,আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূল (সা.) বলেছেন : আল্লাহ তা‘আলা তিন শ্রেণীর লোকের সাথে ক্বিয়ামতের দিন কথা বলবেন না। (১) বয়ঃপ্রাপ্ত যেনাকার (২) মিথ্যুক শাসক (৩) অহংকারী দরিদ্র।২২
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন : রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘যে অহংকার বশত পায়ের নিচে লুঙ্গি ঝুলিয়ে রাখে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তার প্রতি দৃষ্টি দিবেন না’।২৩
এ হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, যারা অহংকার
করে টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পরবে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তাদের দিকে দৃষ্টি
দিবেন না। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে মুসলিম পুরুষরা
লুঙ্গি, পাজামা, প্যান্ট গোড়ালীর নিচে ঝুলিয়ে পরে। এটা যেন এখন একটা
ফ্যাশান। অথচ এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এ বিষয়ে কোন মানুষ চিন্তা করে না।
এর মধ্যে কোন ভদ্রতা ও শালীনতা নেই। বরং এর পরিণাম হচ্ছে জাহান্নাম। তাই এ
বিষয়ে প্রত্যেক মুসলিম পুরুষকে সজাগ ও সচেতন হওয়া জরূরী। জান্নাত পিয়াসী
মুসলিম পুরুষকে টাখনুর উপরে কাপড় পরিধান করতে হবে। অন্যথা পরকালে তাদেরকে
জাহান্নামে যেতে হবে।
মনে রাখতে হবে যে, জ্ঞান ও বিদ্যার
শ্রেষ্ঠত্ব এবং পদমর্যাদার উচ্চতা নিয়ে বড়াই করা খুবই নিকৃষ্ট ধরনের
অহংকার। যে ব্যক্তি আখিরাতের উদ্দেশ্যে বিদ্যা বিশেষত ইসলামী জ্ঞান অর্জন
করে, সে অহংকারী হতে পারে না। সে সবসময় নিজের মনের ওপর পাহারা বসিয়ে রাখে
এবং কড়া নজর রাখে। এ ব্যাপারে শৈথিল্য দেখা দিলেই মনে অহংকার আসবে এবং সঠিক
পথ থেকে তাকে বিচ্যুত করে ফেলবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন : যে অহংকার করে
তাকে আমি আমার আয়াতসমূহ থেকে ফিরিয়ে রাখবো। অর্থাৎ অহংকার মানুষের
হেদায়েতের পথ বন্ধ করে দেয়। আর যে ব্যক্তি অহংকার করা ও মুসলমানদেরকে তুচ্ছ
তাচ্ছিল্য করার উদ্দেশ্যে জ্ঞানার্জন করে এবং জ্ঞানার্জনের পর তাদেরকে
বোকা ভাবে, সে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ধরনের অহংকারে লিপ্ত হয়।
অহংকার থেকে বাঁচার উপায়
একটি কথা মনে রাখতে হবে, কিবর তথা অহংকার
এমন একটি কবীরা গুণাহ যা মানুষকে ধ্বংস করে দেয় এবং একজন মানুষের দুনিয়া ও
আখিরাতকে নষ্ট করে দেয়। এ কারণেই একজন মানুষের জন্য অহংকার থেকে দূরে থাকা
বা তার জীবন থেকে তা দুর করা অকাট্যভাবে ফরয। আর এ কথ সত্য যার মধ্যে
অহংকার থাকে সে শুধু আশা করলে বা ইচ্ছা করলেই অহংকারকে দূর করতে বা অহংকার
হতে বিরত থাকতে পারে না। তাকে অবশ্যই এ মারাত্মক ব্যাধির চিকিৎসা গ্রহণ
করতে হবে। অহংকারের চিকিৎসা নিম্নরূপ :
এক. অন্তর থেকে দূরিভূত করা
প্রথমে অহংকারী নিজেকে চিনতে হবে, তারপর
তাকে তার প্রভুকে চিনতে হবে। একজন মানুষ যখন নিজেকে ভালোভাবে চিনতে পারবে
এবং আল্লাহ্ তা‘আলার মহত্ব ও বড়ত্বকে সঠিকভাবে বুঝতে পারবে তখন তার মধ্যে
বিনয় ও নম্রতা ছাড়া আর কিছুই থাকতে পারে না, অহংকার তার থেকে এমনিতেই দূর
হয়ে যাবে। আল্লাহ্ তা‘আলাকে যখন ভালোভাবে চিনবে তখন সে অবশ্যই জানতে পারবে
বড়ত্ব ও মহত্ব একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো জন্য প্রযোজ্য নয়। আর এভাবে সে
তার মন থেকে অহংকার মুছে ফেলতে পারবে।
দুই. অহংকারের উৎসসমূহ থেকে বিরত থাকা
এানুষ যে সব বস্তু নিয়ে অহংকার করে তাতে
চিন্তা ফিকির করা এবং মেনে নেয়া যে তার জন্য এসব বস্তু নিয়ে অহংকার করা
উচিত নয়। কেউ যদি তার বংশ মর্যাদা নিয়ে অহংকার করে, তখন তাকে বুঝতে হবে যে,
এটি একটি মূর্খতা বৈ কিছুই নয়। কারণ সে তো তার নিজের ভিতরের কোন যোগ্যতা
নিয়ে অহংকার করছে না। সে অহংকার করছে অন্যদের যোগ্যতা নিয়ে। যা একেবারেই
বিবেক ও বুদ্ধিহীন কাজ।
তিন. আল্লাহর নিকট সাহায্য যাওয়া
দো‘আ ও আল্লাহর নিকট সাহায্য চাওয়া হল,
অহংকার থেকে বাঁচার জন্য সব চেয়ে উপকারী ও কার্যকর ঔষধ। কারণ, আল্লাহ্
তা‘আলা যাদের হিফাযত করেন, তারাই অহংকার থেকে বাঁচতে পারে। আর আল্লাহর
সাহায্য ছাড়া বাঁচার কোন উপায় নেই। এ কারণে রাসূল সা. উম্মতদের দো‘আ শিখিয়ে
দেন এবং তিনি নিজেও সালাতে বেশি বেশি করে আল্লাহর নিকট দো‘আ মুনাজাত করেন।
এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে : যুবাইর ইব্ন মুতইম রা. হতে বর্ণিত,
তিনি রাসূল সা. কে একবার সালাত আদায় করতে দেখেন, তখন তিনি রাসূল সা.কে
সালাতে এ কথাগুলো বলতে শোনেন :
الله أَكْبر كَبِيًرا الله أَكبر
كَبِيًرا الله أَكبر كَبِيًرا وَالحَمْدُ لله كَثيِراً وَالحَمْدُ لله
كَثِيراً وَالحَمْدُ لله كَثِيراً وَسبحَانَ الله بُكْرَةً وََأِصيلًا
ثَلَاًثا، أَعُوذُ باِلله مِنْ الشَّيطْاَنِ الرجيم مِنْ نَفْخِهِ
وَنَفْثِهِ وَهمْزِه
“আল্লাহ
তা‘আলা সব কিছু হতে বড়, আল্লাহ্ তা‘আলা সবকিছু হতে বড়, আল্লাহ্ তা‘আলা
সবকিছু হতে বড়। আর সর্বাধিক প্রশংসা কেবলই আল্লাহরই, আর সর্বাধিক প্রশংসা
কেবলই আল্লাহরই, আর সর্বাধিক প্রশংসা কেবলই আল্লাহরই। আর আমি বিতাড়িত শয়তান
হতে তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি, আমি আরও আশ্রয় চাচ্ছি তার অহংকার থেকে তার
প্ররোচনা থেকে ও ষড়যন্ত্র থেকে।”২৪
চার. আত্মপরিচয় সম্পর্কে অবগত হওয়া
যে ব্যক্তির মধ্যে অহংকার আসে তার চিন্তা
করে দেখা উচিত যে, অহংকার কোন্ কারণে এসেছে, এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, অহংকার
দূর করতে হলে নিজেকে এবং প্রভুকে চিনতে হবে। মানুষকে এক ফোটা তুচ্ছ পানি
দ্বারা পয়দা করা হইয়াছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :
هَلْ أَتَى عَلَى الْإِنْسَانِ
حِينٌ مِنَ الدَّهْرِ لَمْ يَكُنْ شَيْئًا مَذْكُورًا . إِنَّا خَلَقْنَا
الْإِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ نَبْتَلِيهِ فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا
بَصِيرًا.
“মানুষের
উপর এমন এক সময় কি আসেনি? যখন সে উল্লেখযোগ্য কোন জিনিসই ছিল না। নিশ্চয়ই
আমি মানুষকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে সংমিশ্রিত ধাতু দ্বারা সৃষ্টি করেছি।
অুঃপর আমি তাকে শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টি শক্তির অধিকারী করেছি।”২৫
১. ইবনে মানযুর, লিসানুর আরব, (বৈরূত : দারুল ফিকর, তা.বি.), খ. ৫০, পৃ. ১২৫
২. মুসলিম, আস-সহীহ, পৃ. ৯১
৩. দার কুতনী, খ. ৪, পৃ. ২০৬
৪. তারিখে বাগদাদ, খ. ১০, পৃ. ৩০৭
৫. সিয়ার আলাম আন নুবালা, খ. ৭, পৃ. ৪০৭
৬. সূরা আল-আলাক, আয়াত : ৬-৮
৭. আল্লামা বাগাভী, তাফসীরু মাআলিমুত তানযীল, খ. ৮, পৃ. ৪৯৭
৮. বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং-৫০৯৬
৯. ইসলাহে নাফস, পৃ. ১২
১০. সূরা সাদ, আয়াত : ৭১-৮৭
১১. সূরা আল-কাসাস, আয়াত : ৩৮-৪২
১২. সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত : ৭৫-৭৮
১৩. সূরা ফুসসিলাত, আয়ত : ১৫-১৬
১৪. সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত : ৮৮-৯২
১৫. সূরা নূহ, আয়াত : ৫-১০
১৬. সূরা নূহ, আয়াত : ২৫-২৮
১৭. সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত : ৮৭-৯০
১৮. সূরা আল মু’মিন
১৯. সূরা আন্-নাহল, আয়াত : ২৩
২০. সহীহ মুসলিম
২১. তাবারানী
২২. মুসলিম, মিশকাত, হাদীস নং-৫১০৯
২৩. বুখারী, হাদীস নং-৫৩৪২
২৪. আবূ দাউদ, আস-সুনান, খ. ৪, পৃ. ৪২৭, হাদীস নং-৪৯০৫।
২৫. সূরা আদ-দাহর, আয়াত : ১-২
No comments:
Post a Comment